কয়েক দিনের ভারি বর্ষণে নোয়াখালীর ৯ উপজেলার বসতঘর, গ্রামীণ সড়ক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়ছে লাখ লাখ মানুষ।
এমন বাস্তবতায় খাল উদ্ধার ও পানি নিষ্কাশনে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চেয়েছেন স্থানীয়রা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, টানা এক সপ্তাহের ভারি বর্ষণে জলাবদ্ধতা দেখা দেয় নোয়াখালী জেলাজুড়ে। জেলা সদর, সেনবাগ, সোনাইমুড়ী, চাটখিল, বেগমগঞ্জ, কবিরহাট, কোম্পানীগঞ্জ, সুবর্ণচর উপজেলার বেশির ভাগ নিচু এলাকা প্লাবিত হয়। এতে সীমাহীন ভোগান্তির মধ্যে পড়েন এসব উপজেলার বাসিন্দারা।
বৃষ্টির পানিতে ডুবে যায় আমন ধানের বীজতলা, শাকসবজি। এ ছাড়া মাঠে পানি বেশি থাকায় অনেক এলাকার কৃষক ক্ষেতে আমন লাগাতে পারছেন না।
পানিতে ডুবে গেছে সড়ক। বাসাবাড়িতেও ঢুকছে পানি। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় দীর্ঘ সময়ের ব্যাপক জলাবদ্ধতায় চরম দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে নোয়াখালীবাসীকে।
সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় দ্রুতই জলাবদ্ধতা নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানান পানিবন্দি মানুষজন।
স্থানীয় আবহাওয়া অফিস বলেছে, সোমবার ভোর ছয়টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ছয়টা পর্যন্ত জেলায় ১৭৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। দিনেও বৃষ্টি অব্যাহত আছে।
জেলার সদর উপজেলার পশ্চিম চর উরিয়ার বাসিন্দা রেজাউল হক বলেন, ‘টানা কয়েক দিনের ভারি বর্ষণে বাড়ির চারপাশে পানি ওঠে গেছে। ডুবে গেছে চলাচলের রাস্তা। গত রাতের টানা বৃষ্টিতে পানি এখন রান্নাঘরে ঢুকে গেছে।
‘বাড়ির কেউই ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। ফলে চরম দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে।’
স্থানীয়রা জানান, শহরের সব রাস্তা পানির নিচে তলিয়ে গেছে। বাসার ভেতরে পানি ঢুকে পড়ায় অনেকে বাসা থেকে বের হতে পারছেন না। রাস্তা ফাঁকা হয়ে গেছে।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা সাহাব উদ্দিন বলেন, ‘রাস্তাঘাট ডুবে এখন মানুষের বসতঘরে পানি ঢুকে গেছে। মাছের ঘেরসহ সব ভেসে গেছে। এত পানি আগে দেখিনি।
‘বৃষ্টি হলে পানি নেমে যায়, কিন্তু এবার পানি নামছে না। পানিবাহিত অসুখ বেড়েই চলছে।’
কবিরহাট উপজেলার বাসিন্দা রুবেল বলেন, ‘হাঁটু পানি দিয়ে আমাদের চলাফেরা করতে হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় অবৈধভাবে বাঁধ দিয়ে মাছের ঘের করেছে প্রভাবশালীরা। খাল দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ ৎকরা হয়েছে।
‘কোথাও কোথাও খাল দখল করে বাড়িঘরও নির্মাণ করা হয়েছে, যার কারণে পানি নামছে না। সেনাবাহিনী এসব অবৈধ স্থাপনা ভেঙে দিয়ে খাল পরিষ্কার করে দিলে জলাবদ্ধতা থাকত না।’
সেনবাগ উপজেলার ইব্রাহিম বলেন, ‘টানা বৃষ্টিতে বাড়ির উঠানে পানি জমেছে। রান্নাঘরেও পানি। পানির কারণে আজ রান্নাও করতে পারিনি।
‘কলের পানিতে ময়লা আসে। আমরা অসহায় অবস্থায় আছি।’
সুবর্ণচর উপজেলার হারিচ চৌধুরী এলাকার বাসিন্দা ফারজানা আক্তার বলেন, ‘সুর্বণচরের বেশির ভাগ এলাকার কৃষিজমি তলিয়ে গেছে। বীজতলা নষ্ট হয়ে গেছে। কৃষকরা হাত গুটিয়ে বসে আছেন।
‘প্রশাসন যদি পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করে দিত তাহলে কৃষক বাঁচতে পারত।’
জেলাজুড়ে জলাবদ্ধতার কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ চরম বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। বৃষ্টির পানিতে ময়লা মিশে দেখা দিয়েছে পানিবাহিত রোগ। এসব মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য প্রশাসন ও ধনীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
নোয়াখালীর আবহাওয়া কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের কারণে টানা বৃষ্টিপাত হয়েছে। সোমবার ভোর ছয়টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ছয়টা পর্যন্ত ১৭৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।
‘দিনেও বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। যেহেতু সতর্ক সংকেত চলছে, আমরা জেলেদের তীরবর্তী স্থানে থাকতে বলেছি।’
পানি উন্নয়ন বোর্ড নোয়াখালীর নির্বাহী প্রকৌশলী মুন্সী আমির ফয়সাল বলেন, ‘নোয়াখালীতে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, যা বিগত ২০ বছরেও হয়নি। এ ছাড়া জোয়ার থাকায় পানি নামতে পারছে না।
‘আমরা জলাবদ্ধতা রোধ প্রকল্পে শহর ও আশপাশের ১৬১ কিলোমিটার খাল খনন করেছি। এতে করে সব উপজেলায় পানি নিষ্কাশন হওয়ার কথা। তা ছাড়া পুরোপুরি জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পেতে ড্রেন ও নালা রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন।’
জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘সকলের সহযোগিতায় আমরা জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করছি। এরই মধ্যে বিভিন্ন অবৈধ বাঁধ কেটে পানি স্বাভাবিক করার কাজ শুরু হয়েছে। বৃষ্টিপাত কমে গেলে পানি কমে যাবে।
‘এ ছাড়া বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে আশ্রয় দেয়ার জন্য উপজেলা পর্যায়ের সকল মাধ্যমিক, প্রাথমিক প্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসাসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানদের বলা হয়েছে। যেখানে যে সহযোগিতা প্রয়োজন, আমরা তা করছি।’